আদিকথা ও নামকরণ:

বৌদ্ধ, হিন্দু, মোঘল, পাঠান আমলসহ ইংরেজ শাসনামলের স্মৃতি বিজড়িত আমাদের এই গাইবান্ধা জেলা। বিভিন্ন শাসনামলে নানা সংগ্রাম-বিদ্রোহ এ অঞ্চলে সংঘটিত হয়েছে। গাইবান্ধা আদিতে কেমন ছিল সে বিষটি প্রথমে আলোচনা করা দরকার। বিভিন্ন সুত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য  এব্যাপারে বেশ কিছু ধারনা দেয়। গাইবান্ধা জেলার মুল ভুখন্ড নদীর তলদেশে ছিল এবং কালক্রমে যা নদীবাহিত পলিতে ভরাট হয় এবং এতদঞ্চলে সংঘঠিত একটি শক্তিশালী ভুমিকম্পের ফলে নদী তলদেশের উত্থান ঘটে এবং স্থলভূমিতে পরিণত হয়। তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদী বাহিত পলি মাটি দিয়েই গড়ে উঠেছে আজকের গাইবান্ধা।

 

হারুণ-উর-রশিদ প্রণীত, ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত ‘জিওগ্রাফি অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে এ ব্যাপারে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। এতে বলা হয়েছে যে, ‘‘১৭৮৭ সালের ভয়াবহ বন্যা এবং ১৮৯৮ সালের শক্তিশালী ভূমিকম্পের ফলে বৃহত্তর রংপুর ও বগুড়া অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতির যথেষ্ঠ পরিবর্তন ঘটে। তিস্তা নদীর গতিপথ পরিবর্তন, দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট ও গাইবান্ধার তুলশীঘাটের মধ্যবর্তী ১৫ মাইলের বিস্তীর্ণ নদী ভরাট হয়ে যাওয়া এবং করতোয়া, ঘাঘট ও কাটাখালীর মত ছোট ছোট নদীর উৎপত্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

 

জিওগ্রাফি অব বাংলাদেশের এ তথ্য থেকে গাইবান্ধার আদি অঞ্চল যে নদ-নদীতে পরিপুর্ণ ছিল তার কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে বগুড়া জেলার ইতিহাস গ্রন্থে লেখা হয়েছে যে, ‘৬৪২ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বখ্যাত চীনাপরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ যখন পৌন্ড্র বর্ধন (বগুড়ার মহাস্থানের সাবেক নাম) এলাকা থেকে পুর্ব উত্তরে কামরুপে যান সে সময় তাকে একটি বিরাট নদী অতিক্রম করতে হয়েছিল’’। হিউয়েন সাঙ এর ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে জানান যায় যে, বর্তমান গাইবান্ধা জেলা শহর ও তৎসংলগ্ন এলাকা সপ্তম শতাব্দীতে নদীগর্ভে ছিল। কেনো না পৌন্ড্র বর্ধন থেকে কামরুপ যাওযার যে নদী পথের কথা হিউয়েন সাঙ এর বিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছে, সে পথ গাইবান্ধা জেলার উপর দিয়েই পড়ে। গাইবান্ধা যে আদিতে নিন্মাঞ্চল ছিল এর স্বপক্ষে আরো সে সকল তথ্য পাওয়া যায় তাতেও এর সত্যতা মেলে। এ ব্যাপরে এ্যানসিয়েন্ট পলিটিক্যাল ডিভিশন অব ইন্ডিয়া এর বরাত দিয়ে পাবনা জেলার ইতিহাস এ বর্ণিত হয়েছে ‘ খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দিতে টলেমী তার বিখ্যাত জ্যোতিবির্দ্যা গ্রন্থে এতদঞ্চলের অনেক তথ্য পরিবেশন করেছেন। সেই সময় বাংলাদেশে স্থলভাগ অনেক কম ছিল। প্রাচীন মানচিত্রের উত্তরে মহাস্থানগড় (পৌন্ডবর্ধন) দক্ষিণ পুর্বে বিক্রমপুর (ঢাকা) আর চট্টগ্রাম দেখা যায়। পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর মধ্যস্থ অঞ্চলে কোন স্থান দেখা যায় না। এছাড়া উক্তগ্রন্থের মানচিত্রে যে এলাকাটিতে জলা-ভূমি এবং বিশাল নদী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাতে রাজশাহী বিভাগের পাবনা জেলার সাথে সংশ্লিষ্ট চলন বিল, বগুড়া জেলার ধুনট, সারিয়াকান্দি, গাবতলী, সোনাতলা এলাকাসহ গাইবান্ধা জেলার অধিকাংশ স্থলভাগ অন্তর্ভুক্ত হয়। 

এসব তথ্য থেকে ধারণা করা যায় যে গাইবান্ধার অধিকাংশ এলাকা আদিতে জলাশয় ছিল। এছাড়া একতার সত্যতা প্রমাণের আরো যে দু’টি যুক্তি রয়েছে তার একটি হচ্ছে, জেলার বর্তমান শহর এলাকাসহ পাশ্ববর্তী অনেক এলাকাতেই কুপ, নলকুপ কিংবা পুকুর খননকালে যে কালো কাদামাটি দৃষ্টি গোচর হয়, সেই কাদামাটির ধরণ অনেকটা নদী তলদেশের মাটির মতো। অপর যে যুক্তিটি এতদঞ্চলের জলাশয়ের বিষয়টিকে যুক্তিগ্রাহ্য করে তুলতে সহায়ক ভূমিকা রাখে তা হচ্ছে, জেলর প্রবীণ লোকজন তাদের পিতামহ প্রপিতামহদের বক্তব্যের সুত্র ধরে যে তথ্য উপস্থাপন করেন তাতে জেলার আদিতে জলাশয়ের আধিক্য এবংস্থলভাগের স্বল্পতার কথারই প্রমাণ মেলে।

বর্তমান গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার পুর্বাংশসহ সমগ্র জেলার মাটির ধরণ হচ্ছে নদীবাহিত পলিমাটি। নদীবাহিত পলিমাটি দ্বারা কালক্রমে ভরাট হয়ে যাওয়া নিম্নভূমি এবং ভুমিকম্পের ফলে গড়ে উঠা স্থলভূমিতেই যে গাইবান্ধা জেলা গড়ে উঠেছে সে কথা জোর দিয়েই বলা যায়। এ ব্যাপারে যে জনশ্রুতি রয়েছে, তা থেকেও এ ধারনার যথার্থতা মেলে। জনশ্রুতি রয়েছে যে আদিতে তিস্তামুখ ঘাট এর অবস্থান ছিল তুলশীঘাটের কাছে। সেখান থেকে জামালপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বিশাল নদী। অপরদিকে গোড়াঘাট পর্যন্ত ১৮ মাইল দুরত্বের চলাচল ছিল একমাত্র নদীপথে। বলা হয়ে থাকে ভূমিকম্পের ফলে তুলশীঘাট ও দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট থানার নদীপথটি ভরাট হয়ে স্থলভাবে পরিণত হয়েছে। এখানে একটি বিষয়ে কিছুটা যুক্তির ছোঁয়া পাওযা যায়। সেটা হচ্ছে আমরা এখন রেলওয়ের যেফেরী ঘাটকে তিস্তামুখ ঘাট হিসাবে আখ্যায়িত করছি তা প্রকৃতপক্ষে তিস্তা নদীর মুখ নয়, বরং যমুনা নদীতে অবস্থিত। রেলের ফেরীঘাটের তিস্তা মুখ ঘাট নামকরণে একথার প্রমাণ মেলে যে তিস্তা নদী যেখানে ব্রহ্মপুত্রে মিলিত হয়েছিল সেখানে রেলফেরীঘাট স্থাপিত ছিল বলেই ঘাটের নামতিস্তা মুখ ঘাট রাখা হয়েছিল। তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর গতিপথ যে পরিবর্তিত হয়েছে তা নদীর বর্তমান অবস্থান থেকে প্রমাণিত হয়। এ প্রসংগে আরেকটি তথ্য বিষয়টির সাথে সংশ্লিষ্ট। দিনাজপুরের ইতিহাস গ্রন্থে মোশাররফ হোসেন উল্লেখ করেছেন যে, ১৮০৭  খ্রিষ্টাব্দের শুরুতে করতোয়া নদী বিরাট রাজা ও রাজা ভগদত্তের সীমানা নির্ধারক নদী ছিল বলে ঐতিহাসিক বুকানন তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এ তথ্য থেকে ধারণা করা যায় করতোয়া অত্যন্ত বিশাল নদী ছিল। এ নদী গাইবান্ধা ঐতিহাসিক বিরাট এলাকা থেকে কামরুপের রাজা ভগদত্তের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে ঐ তথ্যে বলা হয়েছে। আদিকালের কামরুপ এলাকা ধরা হয় আসাম থেকে ময়মনসিংহ জেলা পর্যন্ত। এ থেকেই গাইবান্ধা জেলার ভূখন্ডের কোন অস্তিত্ব ধরা পড়ে না।

মোঘল সম্রাট আকবরের সভা পন্ডিত আবুল ফজল প্রণীত ‘আইন-ই-আকবরী’ নামক গ্রন্থে আকবরের শাসন পদ্ধতি ছাড়াও তাঁর শাসনমালে রাজ্যের সীমানা এবং মহালসমুহের বিবরণ পাওয়া যায়। আই-ই-আকবরী গ্রন্থে ঘোড়াঘাট সরকারের আওতাধীন যে ৮৪টি মহলের বিবরণ রয়েছে তাতে গাইবান্ধা নামে কোন মহালের নাম নেই। অবশ্য সেখানে নামান্তরে বালকা (বেলকা), বালাশবাড়ী (পলাশবাড়ী), তুলশীঘাট, সা-ঘাট (সাঘাটা), বেরী ঘোড়াঘাট, কাটাবাড়ি আলগাঁ ইত্যাদি নাম দেখা যায়। এ থেকে বলা যায় ষোড়শ শতাব্দীতেও গাইবান্ধা কোন উল্লেখযোগ্য ভুখন্ড হিসাবে পরিগণিত হয়নি। ষোড়শ শতাব্দীরও আগে থেকে ঘোড়াঘাট ছিল একটি উল্লেখযোগ্য প্রশাসনিক কেন্দ্র।

 

আদি ভবানীগঞ্জ থেকে গাইবান্ধা:ইংরেজি গভর্ণর জেনারেল ওয়ারেন হেষ্টিংস তার শাসনামলে রংপুর জেলা কালেক্টরেটের আওতায় ১৮৯৩ সালে ২৪ টি থানা প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমান গাইবান্ধা এলাকায় সে সময় ৩টি থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ২৭৮ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে গোবিন্দগঞ্জ থানা এবং ১৮৮ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে সাদুল্যাপুর থানা গঠিত হয়। দু’টি থানাই প্রতিষ্ঠিত হয় ইদ্রাকপুর পরগনায়। অপর থানাটি প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে পাতিলাদহ পরগনায় ৯৩ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে, ভবানীগঞ্জ মৌজায় ভবানীগঞ্জ থানা নামে। রংপুরের কালেক্টর ই-জি গ্লেজিযার এর ১৮৭৩ সালের রিপোর্টে এই তথ্য উল্লেখিত হয়েছে। উক্ত রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে যে, রংপুর জেলার সদর থেকে সাদুল্যাপুর থানার দুরত্ব ছিল ৩৮ মাইল, গোবিন্দগঞ্জ ৫৬ মাইল এবং ভবানীগঞ্জের দুরত্ব ছিল ৫৪ মাইল।

 

ইংরেজ শাসনামলে এতদঞ্চলে সংঘটিত সন্ন্যাস বিদ্রোহ, ফকির মজনু শাহ, দেবী চৌধুরানী, ভবানী পাঠকসহ নানা বিদ্যোহীরা তাদের তৎপরতা চালাতেন মুলত: ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীপথে। তদুপরি গাইবান্ধার পাশ্ববর্তী তুলশীঘাটের সাথে সিপাহী বিদ্রোহের কিছুটা সংযোগ ছিল বলে তথ্য পাওয়া যায়। রতনলাল চক্রবর্তী রচিত বাংলাদেশে সিপাহী বিদ্রোহ’ গ্রন্থে লেখা হয়েছে যে, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় একদল বিদ্রোহী সিপাহী রংপুরের দিকে এগিয়ে আসছে খবর পেয়ে রংপুর ট্রেজারীর সম্পদ রক্ষার্থে তৎকালীন কালেক্টর ম্যাকডোনাল্ড ট্রেজারীর সমুদয় মালামাল ঘোড়ার বহরে করে ৪০ মাইল দুরে তুলশীঘাটের গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে রাখেন। তখন তুলশীঘাট নামক স্থানটি ঘর তুলশী গাছসহ বিভিন্ন গাছ-গাছালিতে পরিপুর্ণ ঘন জঙ্গল ছিল। আর তুলশী গাছের আধিক্যের কারণেই স্থানটির নাম হয়েছিল তুলশীঘাট। রংপুর জেলা থেকে এই সব এলাকার বিদ্রোহীদের তৎপরতা বন্ধ করা সম্ভব ছিল না। সেজন্য প্রশাসনিক কারণে ব্রহ্মপুত্র নদীর তীর ঘেষে ভবানীগঞ্জ থানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীতে এই ভবানীগঞ্জ থানাতেই এতদঞ্চলের মধ্যে প্রথম ফৌজদারী শাসন ব্যবস্থা চালু করা হয় এবং ১৮৫৮ সালের ২৭ শে ভবানীগঞ্জ নামে এক মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হয়। সাদুল্যাপুর ও ভবানীগঞ্জ থানা নিয়ে যাত্রা শুরু হয় মহুকুমা ভবানীগঞ্জের। ১৮২১ সালের ১৩ এপ্রিল গোবিন্দগঞ্জ থানা পাশ্ববর্তী বগুড়া জেলা অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু ১৮৭১ সালের ১২ ই আগস্ট গোবিন্দগঞ্জ থানা বগুড়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভবানীগঞ্জ মহকুমার অন্তর্ভুক্ত হয়। পর্যায়ক্রমে সাঘাটা, ফুলছড়ি, পলাশবাড়ী এবং সর্বশেষে ১৮৭০ সালে সুন্দরগঞ্জ থানা ভাবানীগঞ্জ মহকুমার অন্তর্ভুক্ত হয়।

১৮৭২ সালের প্রথম দিক থেকে ব্রহ্মপুত্র নদীর পুর্বপাড় জুড়ে ভবানীগঞ্জ মহকুমা এলাকায় ব্যাপক নদী ভাংগন শুরু হয় এবং মহকুমা শহর স্থানান্তরিত করা একান্ত অপরিহর্য হয়ে পড়ে। অন্যদিকে রেললাইন প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হলে যোগাযোগের সুবিধার্থে রেল লাইনের কাছাকাছি ভবানীগঞ্জ মহকুমা শহর স্থানান্তরের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

 

ভবানীগঞ্জ মহকুমা পাতিলাদহ পরগনায় স্থাপিত হলেও মহকুমার পশ্চিমাংশ অর্থাৎ বর্তমান গাইবান্ধা শহর এলাকা ছিল বাহারবন্দ পরগনায় এবং এই দুই এলাকা ছিল দুইজন প্রতিদ্বন্দি জমিদারের আওতাধীন। ভবানীগঞ্জ মহকুমায় ফৌজদারী শাসন ব্যবস্থার আওতায় মহকুমা সদরে ভবানীগঞ্জের জমিদারের এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ফৌজদারী আদালত। নদী ভাংগান মারাত্মক আকার ধারণ করায় ১৮৭৫ সালের শেষ দিকে পাতিলাদহ পরগনার ভবানীগঞ্জ মৌজা থেকে ১২ কিলোমিটার পশ্চিমে রাজা বিরাটের কথিত গো-শালা ও গো-চরনভুমি হিসাবে পরিচিত গাইবান্ধা নামকস্থানে মহকুমা সদর স্থানান্তর করা হয়।

 

ভবানীগঞ্জে মহকুমা থাকাকালীন সেখানে প্রশাসনিক সদর দপ্তর, ডাকঘর, ফৌজদারী আদালত, জেলখানা এবং হাসপাতাল থাকলেও দেওয়ানী আদালত সে সময়ে ছিল মুক্তিপুর পরগনাধীন বাদিখালীতে। ভবানীগঞ্জ মহকুমা সদর থেকে বাদিয়াখালীর দুরত্ব ছিল দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় ১০ কিলোমিটার। পাতিলাদহ এবং মুক্তিপুর পরগনার দুই জমিদারের আভিজাত্যের লড়াইয়ের কারণেই মহকুমা সদর থেকে এতদুরে দেওয়ানী আদালত প্রতিষ্ঠিত হয় বলে জানা যায়। ভবানীগঞ্জ মহকুমা সদর এলাকা ছিল মুলত: এই অঞ্চলের তিন জমিদারের জমিদারীতে। ভবানীগঞ্জসহ পাতিলাসহ পরগণাভুক্ত এলাকা ছিল ঠাকুর পরিবারের জমিদারীতে। বলা হয়ে থাকে এই ঠাকুর পরিবারের প্রসন্ন ঠাকুর ছিলেন কবি রবীন্দ্রণাত ঠাকুর পরিবারের শরীক। পাবনা জেলার কুঠিবাড়ী যেমন ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরদে জমিদারী, তেমনি এই পাতিলাদহ পরগনার জমিদারী লাভ করেন প্রসন্ন ঠাকুরের পরিবার। অন্যদিকে বাহারবন্দ পরগনার অংশটি ছিল কাশিম বাজারের কৃষ্ণ নাথের স্ত্রী মহারানী স্বর্ণময়ীর আওতাধীন জমিদার মনীন্দ্র নন্দীর জমিদারীতে। আর মুক্তিপুর পরগণার অংশটুকু ছিল থানসিংহপুরের জমিদার লাহিড়ী পরিবারের অধীন। তাই ভবানীগঞ্জে ঠাকুর পরিবারের জমিদারীতে মহকুমা সদরসহ ফৌজদারী কোর্ট স্থাপিত হলে থানসিংহপুরের জমিদার ইংরেজ সরকারের সাথে যোগাযোগ করে দেওয়ানী আদালতটি তাদের জমিদারী এলাকা মুক্তিপুর পরগনাধীন বাদিয়াখালীতে স্থাপন করেন।

১৮৭৫ সালে নদী ভাঙ্গন কবলিত ভবানীগঞ্জ এলাকা থেকে মহকুমা সদর যখন গাইবান্ধা নামক স্থানে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তখনভবানীগঞ্জের জমিদার ঠাকুর পরিবার এবং থানসিংপুরের জমিদার লাহিড়ী পরিবারের মধ্যে চরম দ্বন্দ্বের সৃস্টি হয়। উভয় জমিাদর তাদের নিজ নজি জমিদারীতে নতুন মহকুমা সদর স্থাপনের প্রচেষ্টা চালান।

কিন্তু সে সময়ের কয়েকজন বিশিষ্ট আইনজীবি এবং করনীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তার উদ্যোগে ১৮৭৫ সালে মহারানী স্বর্ণময়ীর দান করা বাহারবন্দ পরগণার গাইবান্ধা নামক স্থানে মহকূমার নতূন প্রশাসনিক ভবন ও আদালত ভবন প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাদীয়াখালী থেকে দেওয়ানী আদলত নব-নির্মিত প্রশাসনিক ভবন সংলগ্ন এলাকায় স্থানান্তরিত হয় । এদিকে ভবানীগঞ্জ মৌজাটি ব্রক্ষপুত্রের ভাংগনে বিলীন হতে শুরু করলে মহকূমার নাম পরিবর্তন করে গাইবান্ধা মহকূমা নামকরন করা হয়। তবে মহুকূমার নাম পরিবর্তন এর ক্ষেত্রেও তিন জমিদারের আভিজাত্যের লড়াই মুখ্য ভূমিকা রেখেছে বলে অনেকেই মনে করেন ।

 

নতুন নামে, নতুন স্থানে গাইবান্ধ। মহকুমার গোড়াপত্তন হবার পর শহরাঞ্চল গড়ে উঠতে শুরু করে। ১৯০১ সালে গাইবান্ধা মহকুমা শহর এলাকার আয়তন ছিল ২-৩৩ বর্গমাইল এবং শহরের লোকসংখ্যা ছিল মাত্র ১,৬৩৫ জন। গাইবান্ধা শহরের গোড়া পত্তনের পর ধীরে ধীরে জনসংখা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ১৯২৪ সালে শহর এলাকার জনসংখ্য। বেড়ে দাড়াঁয় ৮ হাজারে । ১৮৭৫ সালে মহকূমা শহর ভবানীগঞ্জ থেকে গাইবান্ধায় স্থানান্তরের সময় মহকুমা প্রশাসক ছিলেন দেলওয়ার হোসেন। আশির দশকে মহকূমা গুলোতে জেলায় রুপান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়া হলে ১৯৮৪ সালের ১৫ ই ফেব্রুযারী গাইবান্ধা মহকূমাও জেলায় রুপান্তরিত হয়।

 

বর্ধন কূঠি প্রসংগ:গাইবান্ধার ইতিহাসের সাথে গোবিন্দগঞ্জের বর্ধনকূঠি রাজবংশের সমৃদ্ধ ইতিহাস আলোচনা করা একান্ত অপরিহার্য। ইদ্রাকপুর পরগনা ছিল এতদঞ্চলের মধ্যে এক বিশাল পরগণা। এই পরগণার সদর দপ্তর ছিল গোবিন্দগঙের বর্ধন কুঠিতে। চতুর্দশ শতকের গোড়ার দিকে রাজা নারায়ণ ছিলেন দেব বংশীয় এবং নিরাজগঞ্জের তাড়াশের জমিদার বংশের লোক । রংপুরের কালেকটর গুডল্যাড সাহেবের ১৭৮১ সালের ইদ্রাকপুর সম্পর্কিত রিপোর্ট থেকে জানা যায় রাজেন্দ্র নারায়ণ থেকে আর্যাবর পর্যন্ত ১৪ জন জমিদার বা রাজা বর্ধনকূঠির শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। তারপর আর্যাবরের পুত্র রাজা ভগবান এবং তার পুত্র রাজা মনোহর বর্ধন কুঠিয় দায়িত্ব প্রাপ্ত হন।  রাজা মনোহন নাবালক পুত্র রঘুনাথকে রেখে মৃত্যূবরণ  করলে বাংলার সুরেদার শাহ সুজার আমলে মধুসিংহ নামে পার্শ্ববতী এক জমিদার বর্ধনকুঠির পাচঁ আনা অংশ দখল করে নেন। পরে ১৬৬৯ সালে মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব মধুসিংহকে উচ্ছেদ করে রঘুনথকে জমিদারী ফরমান দেন। আওরঙ্গজেবের এই সনদ মোতাবেক রংপুর মাহীগঞ্জ, স্বরুপপুর (রংপুর-সৈয়দপুরের মধ্যবর্তি স্থান) এবং দিনাজপুর  জেলার পলাদশী নামের পরগনা গোবিন্দগঞ্জের এই বর্ধনকূঠির আওতায় আসে। ১৯৪৭ সালে ইতিহাস খ্যাত বর্ধন কূঠির সর্বশেষ রাজা শৈলেশ চন্দ্র ভারতে চলে যান। বর্ধন কূঠিরে অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন রক্তসাগর, দূধসাগর, সরোবর নামের বিশাল ধ্বংসাবশেষ, গোবিন্দগঞ্জ ডিগ্রী কলেজ এলাকায় এখনও বিদ্যমান রয়েছে। তবে প্রয়োজনীয় সংরক্ষণের অভাবে এবং কলেজ কতৃক ঐতিহাসিক নিদর্শন সমূহ বিনষ্ট করে নতুন ভবন নির্মাণ করায় অতীতের স্মৃতির ঐতিহাসিক চিহ্ন সমূহ এখন বিলুপ্ত প্রায়।

গাইবান্ধা নামকরণ প্রসংগঃ জেলা শহরের বর্তমান অবস্থানের গাইবান্ধা নামকরণ ঠিক কবে নাগান হয়েছে তার সঠিক তথ্য এখনও পাওয়া যায় নি।  তবে রংপূরের কালেকক্টর ইজি, গ্লেজিয়ার ১৮৭৩ সালে যে রিপোর্ট প্রণয়ন করেছিলেন সেই রিপোর্ট গাইবান্ধা নামটি ইংরাজীতে লেখা হয়েছে এণঊইঅঘউঅ এবং সেই এণঊইঅঘউঅ  এর অবস্থান হিসেউেল্লেখ করা হয়েছে ঘাঘট পাড়ের কথা। এই ঘাটটই যে ঘাঘট নদী সেটা বলা যায়। রংপুরের গ্লেজিয়ার সাহেবের পূর্বে কালেকটর ছিলেন জেমস রেনেল। তার প্রণীত রেনেল জার্নালস থেকে জানা যায় ১৭৯৩ সালে উত্তর বঙ্গে  পুনভাব, ধরলা, তিস্তা, মানস এবং ঘাঘট খাল নৌ পরিবহনে সহায়ক ছিল। লেখা হয়েছে ঘাঘট খালে জানুয়ারী মাসেই বিরাট বিরাট নৌকা চলাচল করতো। জেমস রেনেল এবং ইজি গ্লেজিয়ার দুজন কালেক্টরের রিপোর্টেই অবশ্য ঘাঘটকে খাল হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেদিক থেকে বোঝা যায় ঘাঘট নদী ১৭৯৩ সালেও সে সময়ের নদী গুলোর  চাইতে ছোট আকৃতির ছিল বলেই ঘাঘটকে খাল হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার এই তথ্য থেকে আরেকটা বিষয় বলা যায় যে, ১৭৯৩ সালেও মানস নদী ছিল। ঘাঘট নদীর মতই। অপর যে বিষয়টি এই দুটি তথ্য থেকে অবহিত হওয়া যায়, তা ১৭৯৩ সালে গাইবান্ধা নামটি উল্লেখযোগ্য ছিল না। ১৮৭৩ সালে ইজি গ্লেজিয়ার তার রিপোর্টে গাইবান্ধা নামটি উল্লেখ করেন । সম্ভবতঃ ১৭৯৩ সালের আগে ঘাঘট নদীর তীরবতী এই স্থানটি একটি পতিত ভূখভ এবং গোচারণ ভূমি হিসাবে ব্যবহৃত হতো। জনবসতি ছিল না বলেই রংপুরের কালেক্টদের রিপোর্টে গাইবান্ধা নামটি ১৮৭৩ সালের আগে উল্লিখিত হয়নি।

 

গাইবান্ধার নামকরণ সম্পর্কে দুটি কিংবদন্তী প্রচলিত আছো একঢি কিংবদন্তীতে বলা হয়েছে, পাচ হাজার বছর আগে মৎস্য দেশের রাজা বিরাটের রাজধানী ছিল গাইবান্ধার গোবিন্দগজ থানা এলাকায়। মহাভারতের কাহীনি বলা হয়েছে এই রাজা বিরাটের রাজসভায় পঞ্চ পান্ডবের দ্রৌপদীসহ ছদ্মবেশে তদের ১২ বছর নির্বাসনের পরবতী ১ বছর অজ্ঞাত বাস করেছে। অজ্ঞাত বাসকালে যুধিষ্টির কঙক নামে বিরাট রাজর পাশা খেলার সাথী হয়েছিলেন। আর ভীমের দায়িত্ব ছিল পাচকের কাজ করা এবং তার ছদ্মনাম ছিল বল্লভ। বিরাট রাজার মেয়ে রাজকন্যা। উত্তমার নাচ, গান ও বাদ্যযন্ত্র শিক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিলেন অর্জুন বৃহন্নলা ছদ্মনামে। গোশালার দায়িত্বে ছিলেন সহদেব তন্তীপাল নামে এবং অশ্বশালার দায়িত্বে ছিলেন নকূল, তার ছন্দনাম ছিল গ্রন্থিক। আর বিরাট রাজার রানী সুদেষ্ণার গৃহপরিচারিকা হয়েছিলেন সৌরিনদ্রী নামে রৌপদী। বলা হয়ে থাকে এই বিরাট রাজার গো-ধনের কোন তুলনা ছিল না। তার গাভীর সংখ্যা ছিল ষাট হাজার। মাঝে মাঝে ডাকাতরা এসে বিরাট রাজার গাভী লুণ্ঠন করে নিয়ে যেতো। সে জন্য বিরাট রাজা একটি বিশাল পতিত প্রান্তরে গো-শালা স্থাপন করেন। গো-শালাটি সুরক্ষিত এবং গাভীর খাদ্য ও পানির সংস্থান নিশ্চিত করতে। নদী তীরবর্তী ঘেসো জমিতে স্থাপন করা হয়। সেই নির্দিষ্ট স্থানে গাভীগুলোকে বেঁধে রাখা হতো। প্রচলিত কিংবদন্তী অনুসারে এই গাভী বেঁধে রাখার স্থান থেকে এতদঞ্চলের কথ্য ভাষা অনুসারে এলাকার নাম হয়েছে গাইবাঁধা এবং কালক্রমে তা গাইবান্ধা নামে পরিচিতি লাভ করে।

গাইবান্ধা নামকরন সম্পর্কে ভিন্ন মতও রয়েছে। কারণ গাইবান্ধা জেলার সাথে রাজা বিরাটের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে আজও প্রমাণিত হয়নি। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থান যেমন হাতীবান্ধা, বগবান্ধা, চেংড়াবান্ধা, মহিষবান্ধা ইত্যাদি নামে জায়গা থাকায় মনে হয় গাইবান্ধা  নামটি খুব বেশী পুরানো নয়। রাজা বিরাটের সাথে সম্পর্ক থাক বা  না থাক গাইবান্ধা নামটি  যে গাভীর প্রাচুর্য এবং গাভী বেঁধে রাখার ব্যাপার থেকে এসেছে সে কথা ধারণা করা যায়। তবে মহাভারতের সেই রাজা বিরাট যে গাইবান্ধার রাজা বিরাট তার পক্ষেও উল্লেখযোগ্য কিছু যুক্তি রয়েছে। এ প্রসংগে মনূসংহিতার সংস্কৃত শ্লোকে বলা হয়েছে (মনূ ৭/১৯০)।

‘‘কুরুক্ষেত্রাংসচ মৎস্যাংসচ পঞ্চামান, শুরেসেন জান দীর্ঘণ লঘূংশ্চৈব নরামু গ্রীনীকেষু যোধয়েৎ’’ এই শ্লোগানটিতে বলা হয়েছে যে মৎস্যাদি দেশের লোকেরাই রণক্ষেত্রে অগ্রগামী হয়ে যুদ্ধ করত। মহাভারতের বিরাট পর্বে  যে মৎপীদেশের কথা বলা হয়েছে এবং বিশ্ব কোষের অষ্টাদশ ভাগের ৬৯০ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত মনুরবচন অনুসারে রাজা বিরাটকে মৎস্যদেশ অর্থাৎ মাছ প্রধাণ এবং নদীমাতৃক দেশ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেদিক থেকে এই উপমহাদেশের নদীমাতৃক এবং মাছ প্রধান এলাকা বলতে বাংলাদেশের এই অঞ্চলকেই বুঝায়। নরেন্দ্রবসু প্রণীত বিশ্ব কোষের অষ্টাদশ খন্ডে রাজা বিরাট সম্পর্কে উল্লেখ আছে যে ‘‘ঁবরেন্দ্র খন্ডের মধ্যবতী উক্ত বিরাট নামক প্রাচীন জনপদ গাইবান্ধার অন্তর্গত গোবিন্দগজ থানার করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে ৬ মাইল দুরে অবস্থিত। উক্ত বিরাট ঘোড়াঘাটের আলীগাও পরগণার অন্তর্গত। খৃষ্টীয় দশম শতাব্দীতে ঢাকা নগরিতে বাংলার রাজধানী স্থাপিত হলে ঘোড়াঘাটের প্রশাসনিক গুরুত্ব কমতে থাকে এবং সমৃদ্ধ জনপদ ক্রমে নিবিড় অরণ্যে পরিণত হয়। এই সময় বিরাট নামক স্থানে প্রভাবশালী রাজার প্রাসাদ ছিল। এখনে যে সকল ইটের স্ত্তপ দেখা যায় সেটি দেখে মনে হয় রাজধানীটি চতূর্দিকে একেবার ক্ষূদ্রপরিখা বেষ্টিত হবার পর আরেকটি বৃহৎ পরিখা বেষ্টিত ছিল এবং নগরীর মধ্যে ছিল অনেক ভলো ছোট বড় জলাশয়।

রাজা বিরাট প্রসংগে মোশাররফ হোসেন প্রণীত ‘দিনাজপুরের ইতিহাস’ গ্রন্থের ১০ পৃষ্টায় ঐতিহাসিক বুকাননের উদ্বৃতি দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘১৮০৭ সালে করতোয়া নদী রাজা ভগদত্ত এবং বিরাট রাজার রাজ্যের অভিন্ন সীমানায় ছিল। মহাভারতের বর্ণনা অনুযায়ী রাজা ভগদত্ত কমরুপের রাজা ছিলেন। সেই সময় বিরাট রাজার দেশ মৎস্যদেশ নামে পরিচিত ছিল। নদীসমুহ মৎস্যবহুল হওয়ার জন্য এই নামকরণ করা হয়েছিল বলে ধারনা করা যায়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বিরাট রাজা পান্ডবদেরপক্ষ অবলম্বন করেন এবং পুত্রসহ নিহত হন। ‘‘ হিন্দু পঞ্জিকা’’ মতে খৃষ্টপুর্ব ৩২০০ অব্দে এই যুদ্ধ সংঘঠিত হয়। মহাভারতের বর্ণনানুসারে জানা যায় এই যুদ্ধের পুর্বে মৎস্যদেশের সাথে পান্ডবদের যোগযোগ ছিল।

উল্লিখিত তথ্য গাইবান্ধার রাজা বিরাটের প্রাচীনত্ব এবং মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ এবং পঞ্চ পান্ডবদের এখানে অবস্থানের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে। এছাড়া ১২৬৮ সালে প্রকাশিত কালীকমলা শর্মা রচিত ‘‘বগুড়া মেতীহাস বৃত্তান্ত’’ নামক গ্রন্থের ৪র্থ অধ্যায়ে মহা ভারতের সেই মৎস্যদেশ সম্পর্কে উল্লেখ আছে ‘‘ মৎস্যদেশের নামের পরিবর্তন লইয়া এই ক্ষণে এই স্থানে জেলা সংস্থাপিত হইয়াছে। উত্তর সীমা রংপুর জেলা, দক্ষিণ-পুর্ব সীমা দিনাজপুর জেলা। বগুড়া হইতে ১৮ ক্রোশ অন্তর ঘোড়াঘাট থানার দক্ষিণে ৩ ক্রোশ দুরে ৫/৬ ক্রোশ বিস্তীর্ণ অতি প্রাচীণ অরণ্যানী মধ্যে বিরাট রাজার রাজধানী ছিল। তৎপর পুত্র ও পৌত্রগণ ঐস্থানে রাজ্য করিলে পর ১১৫৩ অবন্দে যে মহাপ্লাবন হয় তাহাতে বিরাটের বংশ ও কীর্তি একেবারেই ধ্বংস হইয়া যাওয়ার পর ক্রমেক্রমে ঐ স্থান মহারণ্য হইয়া উঠিল। যখন এ দেশের আদ্যপান্ত তাবৎ লোকেই ঐ স্থাকে বিরাটের রাজধানী বলিয়া আসিতেছে। আর কীচক ও ভীমের কীর্তি যখন ঐ স্থানে অনতিদুরেই আছে আর মৎস্যদেশ যখন বিরাট রাজার রাজ্য ছিল, ভারতবর্ষ ছাড়া অন্য কোন স্থানকে মৎস্য দেশ বলেনা তাখন ঐ স্থানে বিরাট রাজার রাজধানী ছিল তার অন্যথা প্রমাণ করে না। অতএব একথা বলা যায় বিরাট এলাকাটি অত্যন্ত প্রাচীন। এই প্রাচীন এলাকাটি কালীকমল শর্ম্মার মতে ১১৫৩ অব্দের মহাপ্লাবনে প্লাবিত হয়ে নদীগর্ভে তলিয়ে যায় এবং প্রাকৃতিক কারণে আবার তা নদীতলদেশ থেকে উত্থিত হয়। তবে রাজা বিরাটের গোচারণ ভূমির সাথে গাইবান্ধা নামকরণের সম্পর্ক যদি নাই থাকবে তবে রাজা বিরাটের এই কিংবদন্তীটি লোকমুখে এত ব্যাপকভাবে প্রচারিত হলোই বা কেন? যুক্তিহীন বা ভিত্তিহীন কোন বিষয়ের এত ব্যাপক প্রচার কোনক্রমেই সম্ভব নয় বলে ধারণা করা যায়। সুতরাং আমরা বলতে পারি গাই (গরু/গাভী) বাঁধা থেকে এলাকার নামকরণ হয়েছে গাইবান্ধা। তবে এই গাইবান্ধার ব্যাপারটি রাজা বিরাটের না হয়ে জমিদার ভগদত্তের গোয়ালঘর বা গো-শালার নামানুসারে এলাকর নাম ‘‘ গাইবান্ধা’’ হয়েছে বলেও মনে করা হয়।

 

মুক্তিযুদ্ধে গাইবান্ধা

ভূমিকাঃ ব্যবসায়িক অজুহাতে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নামে এই উপ-মহাদেশে ইংরেজদের আগমন ঘচে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ঘটিয়ে তারা গোটা ভারতবর্ষের শাসন ক্ষমতা দখল করে। ভারতবর্ষ বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা হারিয়ে এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে শুরু করে এবং মূলতঃ তখন থেকেই এ দেশের মানুষের মনে স্বাধীনতার চেতনার সূত্রপাত ঘটে। এরই ফলশ্রুতিতে একে একে সংঘটিত হতে থকে সিপাহী বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, টংক আন্দোলন, নানকার আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন।

প্রায় দু’শ বছর শাসন এবং শোষণ করার পর বৃটিশরা ১৯৪৭ সালে চলে যাওয়ার আগে চক্রান্তের মাধ্যমে বৃটিশ শাসিত গোটা ভারতবর্ষকে তিন অংশে ভেঙ্গে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ করে দিয়ে যায়। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে দুটি রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে ভারত গড়ে উঠলেও সাংবিধানিকভাব ভারত কখনো হিন্দু রাষ্ট্র হয়নি। কিন্তু মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে যে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয় তা সাংবিধানিকভাবেই মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে পরিণত হয়। দ্বিজাতিত্ত্বের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা পাকিস্তানে শুরু থেকেই বাঙালিরা সর্বক্সেত্রে শোষণ, বঞ্চনা ও উপক্ষোর শিকার হতে থাকে।

পাকিস্তান সৃষ্টির এক বছরের মধ্যেই উর্দুকেই রাষ্টা ষাভা হিসেবে ঘোষণা কর বাঙালির উপর ভাষার বোঝা চাপানোর চেষ্টার সাথে সাথে বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটে। ফলশ্রুতিতে গড়ে ওঠে বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন। সৃষ্টি হয় বাঙালি জাতির সংগ্রামী ঐতিহ্যের চেতনা একুশে ফেব্রুয়ারী। শহীদ হন- সালাম, জববার, রফিক, বরকত, সালাহউদ্দিন প্রমুখ। এই রক্তস্নাত আন্দোলনের ফলে ৫৪-এর নির্বাচনে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটিয়ে বিজয়ী হয়। কিন্তু চক্রান্ত করে কিছু দিনের মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় যুক্তফ্রন্ট সরকারকে। পরবর্তীতে ৫৮ সালে সামরিক আইন জারির এক মাসের মধ্যে আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসেন। ৬২ তে সামরিক আইন ও শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বিরোধী আন্দোলন ৬৬-এর ৬ দফার আন্দোলন, ছাত্র সমাজের ১১ দফা আন্দোলনের পরিণতিতে ’৬৯ সালে পাকিস্তানের শোষণ ও বৈষম্যমূলক শাসনের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান ঘটে। এই সকল আন্দোলন পরিচালনার মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। আইয়ুবের বিদায় ঘণ্টা বেজে ওঠে এবং আরেক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসেন। গণ-অভ্যুত্থানের ব্যাপকতা এবং বাস্তবতা বিবেচনা করে ইয়াহিয়া ঘোষণা করেন সাধারণ নির্বাচনের। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে বিজয়ী হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ৩১৩ আসন-বিশিষ্ট পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং সরকার গঠনের যোগ্যতা অর্জন করে। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে শুরু হয় টালবাহানা এবং চক্রান্ত। ৭১ সালের ১ মার্চ পূর্ব ঘোষিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে সারা পূর্ব বাংলায স্বতঃস্ফুর্ত গণবিক্ষোভ ঘটে। এই গণঅভ্যুত্থান অসহযোগ আন্দোলনে পরিণত হয়। পূর্ব বাঙরার সর্বত্র প্রশান যন্ত্র অচল হয়ে যায। ৬ মার্চ হরতাল পালিত হয। ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করন-‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ৯ই মার্চ পল্টন ময়দানে জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী স্বাধীনতা ঘোষণার সমর্থনে ১৪ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেন। সরা পূর্ব বাংলার জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে।ান্য ককে পাকিস্তানীরা প্রস্ত্ততি নিতে থাকে। বাঙালিদের উপর সশস্ত্র আক্রমণের। ২৫ শে মার্চের কালরত্রিতে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা, ইপিআর বাহিনীর সদর দফতরে আক্রমণের মাধ্যমে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দী করা হলেও স্বতঃস্ফুর্ত পররোধ গড়ে উঠে। পাকিস্তানী আক্রমণের সাথে সাথে অধিকাংশ মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের ৭ই মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা হয়ে ওঠে এক অভ্রান্ত পদ নির্দেশ। বিদ্রোহী বাঙালি স্মলণকালের ইতিহাসের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

পুলিশ ও ইপিআরসহ সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। চট্টগ্রামে চালু হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। সেখান থেকে ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করা হয়। ২৭ শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে জিয়ার কণ্ঠে প্রচারিত স্বাধীনতার ঘোষণা জনগণকে উদ্দীপ্ত করে। ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানীর তত্ত্বাবধানে সারাদেশকে এগারিট সেক্টরে বিভক্ত করে শুরু হয় আমাদের সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম।

স্বাধxীনতা যুদ্ধে গাইবান্ধা ঐতিহাসিক এবং গৌরবময় ভূমিকা পালন করে। স্বাধীনতা সংগ্রামে গাইবান্ধাবাসীর প্রস্তুতি, প্রতিরোধ, যুদ্ধে অংশগ্রহণসহ বিভিন্ন গৌরবময় অবদান এই নিবন্ধে উপস্থাপন করা হলোঃ

প্রাথমিক প্রস্তুতিঃ একাত্তরের ৩ মার্চ ঢাকায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনের পর থেকে দেশব্যাপী পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো আরম্ভ হয়, যা স্বাধনিতা আন্দোলনের অংশে পরিণত হয়। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর স্বাধীনতাকামী মানুষের মুক্তির আকাংখা তীব্রতর হতে থাকে। ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে সর্বত্র পাকিস্তানী পতাকা উড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়। আর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঘোষণা করে দেশ জুড়ে প্রতিরোধ দিবস। ঐদিন গাইবান্ধায় পাকিস্তানী পতাকার পরিবর্তে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২৩ মার্চ সকাল থেকে পাবরিক লাইব্রেরী মাঠে ছাত্র জনতার সমাবেশের প্রস্তুতি চলতে থাকে। দুপুরে ছাত্রলীগের তৎকালীন মহকুমা সভাপতি এম এন নবী লালুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তৃতা করেন আওয়ামী লীগ নেতা নির্মলেন্দু বর্মন, মোহাম্মদ খালেদ, ছাত্রলীগের মহকুমা সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আরেফিন তারেক, সৈয়দ শামস-উল আলম হিরু, সদরুল কবীর আঙ্গুর, আমিনুল ইসলাম ডিউক প্রমুখ। বক্তৃতা শেষে সমাবেশেই পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীন বাংরার পতাকা উড়ানো হয়। এ সময় এম এন নবী লালু পতাকা ধরে থাকেন এবং নাজমুল আরেফিন তারেক পতাকায় অগ্নিসংযোগ করেন। পরে এম এন নবী লালু, নাজমুল আরেফিন তারেক, রিয়াজুল হক বিরু, আব্দুল হাদি মুন্না, শাহ শরিফুল ইসলাম বাবলু, আব্দুস সালাম, নির্মলেন্দু বর্মন ভাইয়া ও আরো অনেকে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই শহরের সর্বত্র পাকিস্তানী পতাকার পরিবর্তে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। গাইবান্ধা কলেজের অধ্যাপক আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী এবং অধ্যঅপক মাজহারুল মান্নানকে যুগ্ম আহবায়ক করে গঠিত শিক্ষক সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে ২৪ মার্চ শহরে মিছিল ও সমাবেশ হয়। কয়েকদিনের মধ্যেই গঠিত হয় মহকুমা সংগ্রাম কমিটি। এর নেতহৃত্বে ছিলেন আওয়াম লীগড় নেতা লুৎফর রহমান, বাংলাদেশের প্রথম স্পীকার শাহ আব্দুল হামিদ, সোলায়মান মন্ডল, ডাঃ মফিজুর রহমান, আবু তালেব মিয়া, এ্যাডভোকেট শামসুল হোসেন সরকার, জামালুর রহমান, ওয়ালিউর রহমান রেজা, আজিজার রহমান, নির্মলেন্দু বর্মন, মতিউর রহমান, হাসান ইমামা টুলু, মোহাম্মদ খালেদ, নাট্যকর্মী গোলাম কিবরিয়া, তারা মিয়া প্রমুখ। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ উদ্যোগী ও সাহসী ভূমিকা পালন করেন। তৎকালীন অবাঙ্গালী মহকুমা প্রশাসক, ব্যাংক কর্মকর্তা রেজা শাজাহান প্রশাসনিকভাবে সংগ্রাম কমিটিকে সহযোগিতা করেন। এর পাশাপাশি সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি চলতে থাকে। নৌবাহিনী থেকে ছুটিতে আসা কাজিউল ইসলাম, বিমান বাহিনীর আলতাফ, আজিম উদ্দিন, আলী মাহবুব প্রধান প্রমুখ গাইবান্ধা কলেজ ও ইসলামিয়া হাইস্কুল মাঠে যুবকদের নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করেন। এ প্রশিক্ষণের ব্যাপারে সার্বিক সহযোগিতা করেন গাইবান্ধা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ অহিদ উদ্দিন আহমেদ।

এ সময় হাসান ইমাম টুলুর সাহসী ভূমিকায় গাইবান্ধা ট্রেজারী তেকে প্রায় দুইশত রাইফেল বের করে নিয়ে ছাত্র জনতার মধ্যে বিতরণ করা হয়। আনসার ক্যাম্প থেকেও কিছু রাইফেল নেয়া হয়। সুবেদার আলতাফ হোসেন তার অধীনস্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাদের নিয়ে দেশ মুক্ত করার সংগ্রাম সংগঠিত করতে গাইবান্ধা চলে আসেন। আলতাফ সুবেদার নামে এই সাহী যোদ্ধা গাইবান্ধা কারাগার থেকে সকল বন্দীকে মুক্ত করে দেন এবং স্বাধনিতা যুদ্ধে অঙশগ্রহণের আহবান জানান। শহরের বিভিন্ন স্থানে চলতে থাকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ। অন্যান্য থানাগুলোতেও চলতে থাকে মুক্তি সংগ্রামের প্রস্তুতি। সাঘাটা থানা সদরের বোনারপাড়া হাইস্কুল মাঠে তৎকালীন গাইবান্ধা মহকুমা আওয়ামী লীগের সম্পাদক ও বোনারপাড়া কলেজের অধ্যক্ষ আতাউর রহমানের উদ্যোগে ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপিত হয়। উক্ত প্রশিক্ষণ শিবিরের সহস্রাধিক প্রশিক্ষণার্থীকে অস্ত্র চালনা ও সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদানের কাজে পুলিশ ও আনসার বাহিনীর প্রশিক্ষকরা নিয়োজিত ছিল। প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালনায় সহযোগিতা করেছিলেন মনসুর রহমান সরকার, মজিবর সিআইডি, রোস্তম আলী খন্দকার, আফছার, গৌতম. বজলু, তপন, রাজ্জাক সহ আরও অনেকে।

বোনারপাড়া জিআরপি থানা ও সাঘাটা থানা হতে রাইফেল-গুলি সংগ্রহ করে প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালনা ও বোনারপাড়ায় প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। রাইফেল সংগ্রহে অধ্যক্ষ আতাউর রহমান, এবারত আলী মন্ডল, রোস্তম, আফছার বজলু ছাড়াও অনেকে ছিলেন। আনসার কমান্ডার আফতাব হোসেন দুদুর নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত আসনার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে এক সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করা হয়। এই দলে মহববত, বজলু, দুদু সহ আরও অনেকে ছিল। এই দল বোনারপাড়া প্রতিরোধের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল সরকারি খাদ্য গুদামের ৩নং বাসাটি। বোনাপাড়ার প্রবেশ মুখে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধের জন্য পরিখা খনন করা হয়। গাইবান্ধা-বোনারপাড়া সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে গাছ কেটে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। বোনারপাড়ায় মুক্তিবাহিনীর এই সকল পদক্ষেপের খবরে হানাদার বাহিনী ব্যাপক প্রস্ত্ততি নিয়ে ট্যাংক কামানে সজ্জিত হয়ে ১৭ এপ্রিল গাইবান্ধা পতনের ৭দিন পর ২৩ এপ্রিল বোনাপাড়ায় আসে। ট্যাংক কামান সজ্জিত বিশাল বাহিনীকে সামান্য ৩০৩০ রাইফেল দিয়ে প্রতিহত করা সম্ভব নয়। এতে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হবে বিবেচনায় এনে হানাদার বাহিনীর অগ্রাভিযানে বাঁধা দেয়া হতে মুক্তিবাহিনীকে বিরত রাখা হয়। ২৩ এপ্রিল বোনারপাড়ার পতন ঘটে।

ছাত্র-যুবকরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে চলে যায়। প্রশিক্ষণ শেষে সাঘাটা থানার ছেলেরা ১১টি সেক্টরে জেড ফোর্স, কে ফোর্স ও মুজিব বাহিনীর অধীনে সক্রিয় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল।

প্রতিরোধ পর্বঃ বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে স্বাধীনতা ঘোষণার ঐতিহাসিক পলাশবাড়িতে ৮মার্চ পিয়ারী উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যাপক হাসান আজিজুর রহমানের সভাপতিত্বে এক সর্বদলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় তোফাজ্জল হোসেনকে আহবায়ক ও ওমর ফারুক চৌধুরীকে সদস্য সচিব এবং এম কে রহিম উদ্দিন (বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের স্বাধনিতা ঘোষণাকারীদের অন্যতম), আইয়ুব আলী মাস্টার, আব্দুল বারেক, সাকোয়াত জামান বাবু, মোফাজ্জল হোসেন, রাখাল চন্দ্র, আব্দুর রহমান, মোস্তাফিজুর রহমান, ডাঃ নিজাম মন্ডল, অরজিৎ কুমার, আব্দুল ওয়ারেছ, গোলজার ব্যাপারী, নজরুল ইসলাম, আব্দুল মান্নান প্রমুখকে নিয়ো ‘হানাদার বাহিনী প্রতিরোধ’ কমিটি গঠিত হয়। কমিটির উপদেষ্টা ছিলেন আজিজার রহমান এমপিএ। এই কমিটি ১০ মার্চ এফইউ ক্লাবে একটি শিবির খোলে এবং পাকিস্তানী পতাকার স্থলে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে। ১২ মার্চ ঢাকা থেকে রংপুরগামী পাকিস্তানী বাহিনীর গাড়ি চলাচলে বাঁধা সৃষ্টি করার জন্য রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়া হয়। পাকিস্তানীরা ব্যারিকেড সরিয়ে রংপুর গেলেও কমিটির উদ্যোগে পাকিস্তানী সৈন্যদের যাতায়াতের বিঘ্ন ঘটানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। ২৭ মার্চ রংপুর থেকে বগুড়াগামী পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পলাশবাড়ি এলাকার মহাসড়কের বেরিকেড ভাঙতে না পেরে গাড়ি থেকে পলাশবাড়ির কালিবাড়ি হাটের নিরীহ জনগণের উপর গুলিবর্ষণ করে। হানাদারদের গুলিতে গিরিধারী গ্রামের তরুণ আঃ মান্নান এবং দুজন বাঙালি পুলিশ নিহত হন।

২৮ মার্চ সীমান্ত এলাকা থেকে ৪০/৫০ সদস্যের ইপিআর বাহিনী পলামবাড়িতে আসে। তাদের সাথে হানাদার বাহিনীর সংঘর্ষে ২১ জন শহীদ হন। পাকিন্তানী হানাদার বাহিনীর দোসর মেজর নিজাম অবশিষ্ট বাঙালি সৈনিকদের নিরস্ত্র করে এবং জানতে পায় ২৫ মার্চ সৈয়দপুর সেনানিবাসে বাঙালি সৈনিকদের উপর হামলা হওয়ায় তারা সশস্ত্র অবস্থায় বেরিয়ে গেছে এবং ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন ফুলবাড়িতে অবস্থান নিয়েছেন। মেজর নিজাম ফুলবাড়ি গিয়ে পাকিস্তানী প্রীতি লুকিয়ে রেখে ক্যাপ্টেন আনোয়ারকে দুর্বল করার জন্য ঘোড়াঘাটে অবস্থানরত ডি কোম্পানীর সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধিার প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করে কিছু সংখ্যক সৈন্য প্রেরণের পরামর্শ দেয়। পরামর্শ অনুযায়ী ২৯ মার্চ তারিখে সুবেদার আফতাব আলী ওরফে আলতাফকে ৬০জন সৈন্যসহ প্রেরণ করা হয়। দূরদর্শী ক্যাপ্টেন আনোয়ার সুবেদার আলতাফকে পলাশবাড়িতে অবস্থানের নির্দেশ দেন। সেনাদলকে নিয়ে পলাশবাড়ির বীর ছাত্র-যুবক-জনতা আরো বেশী সাহসী হয়ে ওঠে। সুবেদার আলতাফ তার বাহিনীকে বিভিন্নভাগে ভাগ করে মাদারগঞ্জ ও আংরার ব্রীজে নিয়োজিত রাখেন। তাঁরা পলাশবাড়িতে ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণও তদারক করেন। সংগ্রাম কমিটি সেনাবাহিনী ও ইপিআর জোয়ানদের আর্থিক সহযোগিতা করতে থাকেন। ৩০ মার্চ মেজর নিজামের পাকিস্তানী প্রীতি উন্মোচিত হয়। সে সকলকে ক্লোজ হতে ও অস্ত্র জমা দিয়ে বিশ্রামে যেতে বলে। কিন্তু সেনাবাহিনীর দামাল সন্তানরা চক্রান্ত বুঝতে পারেন। সৈনিকদের গুলিতে মেজর নিজাম নিহত হলে লেঃ রফিক নেতৃত্ব লাভ করেন।

৩১ মার্চ পলাশবাড়িতে পাক হানাদারা আবারো প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। বাঙালি ইপিয়ার ও সেনাবাহিরন জোয়ানদের সাথে গুলি বিনিময় হয়। এক সময় হানাদার বাহিনী পলাশবাড়ি চৌরাস্তায় উপস্থিত হয। সেখানে ছিলেন লেঃ রফিক। হানাদাররা তাকে ধরে গাড়িতে উঠাতে চেষ্টা করলে সুবেদার অরতাফের সঙ্গী হাবিলদার মনছুর গ্রেফতারকালদদের উপর এলএমজি দিয়ে গুলি চালায়। একজন পাকিস্তানী সৈন্য লেঃ রফিককে পিস্তল দিয়ে গুলি করে। পাবনার নারিন্দা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল আজিজ ও ফাতেমা বেগমের দামাল সন্তান লেঃ রফিক শহীদ হন। নেতৃত্ব পান সুবেদার আলতাফ। সুবেদার আলতাফ পলাশবাড়ি এলাকার মুজাহিদ আনসারদের আহবান জানান স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের সাথে যোগ দিতে। কয়েকদিনের মধ্যে ক্যাপ্টেনসহ ২৫০ জন মুজাহিদ, আনসার তাদের সাথে যোদ দেন। সুবেদার আরতাফের নেতৃত্বাধীন বাহিনী পীরগঞ্জের আংরার ব্রীজ, সাদুল্যাপুরের মাদারগঞ্জ ও গোবিন্দগঞ্জের কাটাখারী ব্রীজসহ পলাশবা[[ড়ড় থানা সদরে অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৪ এপ্রিল ভোরে সশস্ত্র হানাদার বাহিনী ৩০/৩৫টি কনভয় নিয়ে ঢাকা থেকে পলাশবাড়ির উপর দিয়ে রংপুর যায়। ১৫ এপ্রিল রাত আটটায় হানাদার বাহিনী আংরার ব্রীজে পাহারারত বাঙালি সৈনিকদের উপর হামলা চালায়। দীর্ঘ সময়ের তুমুল লড়াইয়ের খবর আসে গাইবান্ধায়। গাইবান্ধা থেকে প্রশিক্ষক কাজিউল ইসলামসহ অন্যান্য প্রশিক্ষক যোদ্ধারা প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে পলাশবাড়ি ছুটে যান ও যুদ্ধে অংশ নেন। আংরার ব্রীজের যুদ্ধে পাঞ্জাবী হানাদাররা পিছু হটে যায়। তখন হাবিলদার মনছুরের নেতৃত্বে একটি প্লাটুন ছিল মাদারগঞ্জে। সুবেদার আলতাফ ভোর রাতে আংরার ব্রীজ ভেঙ্গে দিয়ে কয়েকজন বীর যোদ্ধা নিয়ে রওয়ানা দেন মাদারগঞ্জে। মাদারগঞ্জে পৌঁছে সুবেদার আলতাফ প্রায় ৫০ গজ দূর থেকে লক্ষ্য করেন ৫/৬টি মেশিনগান সংযোজিত গাড়ি থেকে পাঞ্জাবীরা নেমে অবস্থান নিচ্ছে। গাড়িগুলো একটু সরে গিয়েই মেশিনগানের গুলি ছুড়তে থাকে। সুবেদার আলতাফ তড়িৎ ফিরে এসে পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করেন এবং সেনাসদস্যসহ মুক্তিপাগল প্রশিক্ষণার্থীরা শত্রু নিধনে একযোগে গুলি ছুড়তে থাকেন। শত্রুরা দুদিক থেকে হামলা কর এগুতে থালে সুবেদার আলতাফ ও হাবিরদার মনছুর বীর জোয়ানরে নিয়ে দুদিক থেকে হানাদারদের উপর পাল্টা হামলা চালায়। এসময় প্রায় দুহাজার বীর জনতা দা, বল্লম ও লাঠি হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। মুক্তিযোদ্ধারা আরও বেশি সাহসী হয়ে উঠেন। যুদ্ধে ২১ জন পাঞ্জাবী নিহত হয়। হানাদার বাহিনী ক্রমশঃ পিছু হটতে থাকে। নিহত ও আহতদের ফেলে রাখা ১৭টি রাইফেল ও একটি এলএমজি মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয। যুদ্ধে বীর বাঙালি নূরুল আমিন আহত হন। তাঁকে মাদারগঞ্জ থেকে গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। এ সময় খবর আসে হানাদার পাঞ্জাবী সৈন্যরা শঠিবাড়ি হয়ে গাইবান্ধা অভিমুখে এগুচ্ছে। পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে হানাদারদের অস্ত্র ও সামরিক শক্তির মোকাবেলা সম্ভব নয় বলে সকল শক্তি একত্রিত করে মুক্তিযোদ্ধারা গাইবান্ধায় অবস্থান নিতে ছুটে আসেন। গাইবান্ধায় অবস্থান নেয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা। পাক হানাদার বাহিনী ভারী ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রসহ গাইবান্ধা শহরের দিকে আসতে থাকে। এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা গাইবান্ধা শহর ত্যাগ করে। মুজিবনগরে যে দিন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয় সেই দিন (১৭ এপ্রিল) বিকেল ৩টায় পাক হানাদার বাহিনী গাইবান্ধা শহরে প্রবেশ করে। মুক্তি সেনানীরা শহর ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যায় এবঙ সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে দেশের মুক্তির জন্য পুনরায় প্রস্ত্ততি নিতে থাকে।

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণঃ গাইবান্ধার বীর সন্তানেরা ছড়িয়ে পড়ে কুড়িগ্রামের রৌমারী, রাজিবপুর ও চিলমারীর মুক্ত এলাকায় এবং ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব পাড়ের নিরাপদ স্থানে। গাইবান্ধার নির্বাচিত প্রতিনিধির অনেকেই বিএসএফ (সীমান্ত নিরাপত্তারক্ষী) এর সাথে যোগাযোগ করে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য ছুটে যাওয়া দামাল সন্তানদের সংগঠিত করে তাদের আশ্রয় ও মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য তৎপর হন। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে সীমান্ত এলাকায় যুবকদের সংগঠিত এবং প্রশিক্ষণের জন্য তৎপর হন। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে সীমান্ত এলাকায় যুবকদের সংগঠিত এবং প্রশিক্ষণের জন্য ১১০টি যুব অভ্যর্থনা শিবির খোলা হয়। এরমধ্যে মানকারচরের স্মরণতলী এবং কুচবিহারের খোচাবাড়ি শিবিরের কাম্প-ইনচার্জের দায়িত্ব পান গাইবান্ধার দুই এমপিএ যথাক্রমে ডাঃ মফিজুর রহমান এবং ওয়ালিউর রহমান রেজা। শিবিরগুলোতে নবাগতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। গাইবান্ধার বিভিন্ন অঞ্চলে স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবকদের আরও প্রশিক্ষণ প্রদানের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়। গাইবান্ধার প্রশিক্ষণ সংগঠকদের অন্যতম আলী মাহবুব প্রদান ও আনসার কমান্ডার আজিম উদ্দিনের তত্ত্বাবধানে বড়াইবাড়িতে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

ওদিকে বড়াইবাড়ি ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। মানকার চরে অবস্থানরত এমএনএ এবং এমপিএ সহ নেতৃবৃন্দের সার্বিক সহযোগিতায় পরিচালিত বড়াইবাড়ি ক্যাম্প থেকে ব্যাপক প্রশিক্ষণের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাকড়ীপাড়ার প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়। ভারতের বিএসএফ ত্ম সহযোগিতায় উচ্চ প্রশিক্ষণের জন্য কাকড়ীপাড়া ক্যাম্প থেকে ১ম ব্যাচ হিসেবে ১১৩জনকে ভারতের তুরা পাহাড়ে প্রেরণ করা হয়। কাকড়ীপাড়ায় প্রাশকি প্রশিক্ষণ অব্যাহত থাকে। তুরায় চলে ১১৩ জনের গেরিলা প্রশিক্ষণ। সাদুল্যাপুর উপজেলাধীন কামারপাড়া স্কুল মাঠে এবং ঘাগোয়া ইউনিয়নের রূপারবাজার, গিদারী ইউনিয়নের কাউন্সিলের বাজার প্রভৃতি স্থানে মার্চ মাস থেকেই যারা স্থানীয় উদ্যোগে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন তারা হানাদার বাহিনীর তৎপরতায় ছত্রভঙ্গ কাকড়ীপাড়া প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ও সীমান্ত এলাকার অন্যান্য প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে চলে যান। এসময় মুক্তিযুদ্ধ বেগবান হতে থাকে এবং মুক্তিযোদ্ধারা সফলতা অর্জন করতে থাকে। ক্রামন্বয়ে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে।